২০২৭ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে চালু হতে যাচ্ছে একটি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম, যার ভিত্তি গড়ে তোলা হবে চলতি বছরের মধ্যে। এ বিষয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি প্রাথমিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা সংস্কারের দাবি রয়েছে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা নিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের প্রতিফলন থাকবে নতুন শিক্ষাক্রমে।সূত্র জানিয়েছে, এই নতুন শিক্ষাক্রমের ভিত্তি ২০১২ সালের কাঠামো, নাকি ২০২২ সালের আউটকাম-ভিত্তিক সংস্করণকে জনসম্পৃক্ততার আলোকে রূপান্তরিত করা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। ২০১২ সালের কারিকুলাম ছিল পরীক্ষানির্ভর ও পাঠ্যবইকেন্দ্রিক। অন্যদিকে ২০২২ সালের সংস্করণ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও দেশের বাস্তবতায় ছিল বাস্তবতাবর্জিত ও ত্বরিত। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ও শিক্ষার্থীর মানসিক গ্রহণযোগ্যতা ছাড়াই এই সংস্করণ বাস্তবায়িত হওয়ায় সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া, যার চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন।বর্তমান সরকার জুলাইয়ের প্রতিবাদ ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ২০২৭ সাল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে একটি নতুন শিক্ষাক্রম চালুর ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের মতো মৌলিক চেতনা অপরিবর্তনীয় থাকবে। তবে শিক্ষাদান ও মূল্যায়নে গ্লোবাল প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আনা হবে। এতে জুলাই বিপ্লব -এর দাবিরও প্রতিফলন ঘটবে।এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক সাহতাব উদ্দিন জানিয়েছেন, ২০১২ ও ২০২২ সালের কারিকুলাম পর্যালোচনা করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে কোন কাঠামো অনুসরণ করে নতুন রূপরেখা তৈরি করা হবে।শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা সিআর আবরার মন্তব্য করেছেন, আমরা একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন একটি কাঠামো চাই, যেখানে মুক্তচিন্তা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হয়।শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের জানিয়েছেন, এক সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পরিবর্তন বাস্তবসম্মত নয়। তাই ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
নতুন চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়নের জন্য শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি। যদি এই দিকগুলো উপেক্ষিত হয়, তবে এই উদ্যোগও অতীত সংস্কারের মতো সীমাবদ্ধতায় পর্যবসিত হতে পারে। তবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লব যেমন রাজনৈতিক পরিবর্তনের অনুঘটক হয়েছে, তেমনি এটি শিক্ষাক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক দাবির বাস্তব প্রতিফলন। যদি এই চেতনার ভিত্তিতে কারিকুলাম প্রণয়ন হয়, তবে তা শুধু পাঠ্যক্রম নয়, বরং একটি জাতীয় চেতনার রূপান্তরের পথ প্রশস্ত করবে।সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ২০২২ সালের কারিকুলাম ছিল এক উচ্চাকাক্সক্ষী উদ্যোগ, যার বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা ও প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। বিপরীতে জুলাই বিপ্লব -উত্তর নতুন কারিকুলাম যদি যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তবে তা হতে পারে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি টেকসই ভিত্তি- যা শুধু জ্ঞানার্জনের নয়, সমাজ গঠনের দিকেও বড় পরিবর্তনের সূচনা করবে।