রাজনীতি, রুটি-রুজি, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসা প্রায় সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। প্রতিদিন এ মহানগরীতে অন্তত দুই হাজার নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এ কারণে দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী; নাগরিক সেবা হচ্ছে সংকুচিত। জনসংখ্যার ভারে নাগরিক সেবা এলোমেলো। যানজট, খাদ্যে ভেজাল, দূষিত বাতাস– কোনো কিছুই বাগে আসছে না। নিকট ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরীতে পরিণত হয়েছে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ঢাকা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর।জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বৈশ্বিক নগরায়ণ ধারণা-২০২৫ প্রতিবেদনে এই অনুমান করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান জনবহুল নগর এখন ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। তবে যে হারে ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, তাতে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে জাকার্তাকে ছাড়িয়ে যাবে ঢাকা। তখন ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। জনসংখ্যা হবে প্রায় ৫ কোটি ২১ লাখ।জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ সংজ্ঞা প্রাক্কলন প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ৩ কোটি ৬৬ লাখ। শীর্ষে থাকা জাকার্তার জনসংখ্যা ৪ কোটি ১৯ লাখ।
তবে জাতিসংঘের এই তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার দুই সিটি মিলে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৭২৩ জন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৩ লাখ ৫ হাজার ৬৩ জন।বিবিএসের উপাত্তে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সর্বাধিক ৩৯ হাজার ৪০৬ জনের বাস। দুই সংস্থার উপাত্তে অর্ধেকেরও বেশি ব্যবধান কেন এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ড. আমিনুল হক সমকালকে বলেন, দুটিই সঠিক। জাতিসংঘের সামাজিক পরিষদের সংজ্ঞা এবং তাদের প্রাক্কলনের ভিন্নতার কারণে বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে তথ্যের ব্যবধান রয়েছে। জাতিসংঘ ও বিবিএস দুই সংস্থার প্রতিবেদনই আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দুই কোটি হোক আর তিন কোটি কোনোটাই বাসযোগ্য ঢাকার জন্য উপযোগী নয়।
ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ছে দ্বিগুণ হারে
বিবিএসের জনশুমারি প্রতিবেদন বলছে, সারাদেশের তুলনায় দেশের নগর অঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি হারে। শুমারি অনুযায়ী এই হার ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর আগের শুমারি হয় ২০১১ সালে। তখন নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয়ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিবিএসের পুরোনো উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ শহরে বাস করত। এ হার ক্রমে বেড়ে এখন ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবাই ঢাকামুখী
বিবিএসের উপাত্তে দেখা যায়, দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে ঢাকায় বেশি হারে মানুষ আসে বরিশাল থেকে। প্রতিবছর ঢাকায় বসবাস করতে আসা মানুষের মধ্যে বরিশালের ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।দ্বিতীয় ময়মনসিংহ বিভাগের ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তৃতীয় রংপুর বিভাগ থেকে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে কম ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ আসে সিলেট বিভাগ থেকে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ুর প্রভাবকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আমিনুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতেই মূলত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন রাজধানীতে আসছে মানুষ। গ্রামে কৃষিজমি কমছে। অকালে খরা, বন্যায় জীবন-জীবিকার অবলম্বন ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, মাছ ভেসে যাচ্ছে এবং গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। গ্রামীণ প্রায় সব পেশায় এ রকম অভিঘাত দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে জীবিকার তাড়নায় মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এখানে রিকশা চালালেও জীবিকা নির্বাহ করা যায়। উবারের মতো রাইড শেয়ারিং পেশা, অটোরিকশা চালানো– এ রকম বিকল্প কর্মসংস্থানে গ্রাম থেকে আসা হাজারো যুবক যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া শিল্প-সেবা সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজনীতি করতে হলেও নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কেনাকাটা– সবকিছু ঢাকা ছাড়া যেন হয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, পোশাক কারখানা– সব যেন ঢাকাতেই করতে হবে।