যেসব এলাকায় গভীর ভূচ্যুতি থাকে, সেখানে দুইশ-আড়াইশ বছর পরপর মাঝারি বা বড় ভূমিকম্প আসতে পারে। সেই সময়চক্রের ভেতর ঢুকে গেছে বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গত ৪৮৫ বছরের ভূমিকম্প তালিকাভুক্ত করে দেখিয়েছে ঢাকা ও আশপাশে ঐতিহাসিকভাবে মাত্র ছয়টি ভূমিকম্প হলেও গত ১২ বছরে সংখ্যাটা দশে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রস্থলও বদলে গেছে। আগে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেশি ছিল। এখন মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দোহার ও নরসিংদীর দিকে সরে এসেছে।ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এখানকার ভূগর্ভে বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট চাপা পড়ে শক্তি জমছে, যা কখন মুক্তি পাবে, তা কেউ জানে না। তবে হিসাব বলছে, ঝুঁকির দিকটা সামনের দিকে আরও বাড়ছে; কমছে না।১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ এই ৬১ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়, যার সবই রিখটার স্কেলে ৭-এর ওপরে। এরপর দীর্ঘ নীরবতা। অনেক বিশেষজ্ঞ এটাকেই বিপজ্জনক লক্ষণ হিসেবে দেখেন। যেন বড় একটি চাপ জমে আছে; বের হওয়ার পথ খুঁজছে।২০২৪ থেকে রেকর্ড হওয়া ৬০টি ভূমিকম্পে দেখা গেছে, ৩১টি ছিল ৩-৪ মাত্রার মধ্যে। তিনটি ছিল ৪ মাত্রার ওপরে। বাংলাদেশের বাইরে নেপাল, ভুটান, ভারত, চীনেও একই ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যা দেখায় পুরো অঞ্চলই এখন অস্থির বৈশ্বিক ভূতাত্ত্বিক চাপের ভেতর আছে।
সমস্যা হলো, এ ধরনের সতর্কতা অনেক বছর ধরে শোনা গেলেও বাস্তব উদ্যোগ গতি পায় না। ঢাকার ছয় লাখ ভবনের দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ম মানে না এটা অনেকবার রিপোর্টে এসেছে। নতুন ভবনেও একই অবস্থা। বিল্ডিং কোড কার্যকর করার কথা বারবার বলা হলেও বাস্তবে এটি প্রায় অকার্যকর। জরুরি প্রস্তুতির বিষয়ও বেশ নড়বড়ে। ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্রে যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার হয় না। উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ২০১৫ সালে অনুমোদন পেয়েছে; কাজ এখনও পুরো হয়নি। জনবল নেই, মোবিলাইজেশন নেই, অনুশীলন নেই।ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে ৩ হাজার ২০০ ভবন চিহ্নিত হয়েছে। এরপর কিছুই এগোয়নি। চিঠি চালাচালি ছাড়া সিদ্ধান্ত হয় না। এদিকে শহরের লাখো মানুষ জানেই না তারা কতটা অনিরাপদ ভবনে থাকছে।বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করিয়ে দেন, ১৮৬৯-এ কাছাড়, ১৯১৮-তে শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩-এ দুর্গাপুর সব জায়গাতেই বড় ভূমিকম্পের পর ফাটল তৈরি হয়েছিল, যেগুলো এখন সুপ্ত। এগুলোর ভেতরে শক্তি জমে আছে। ছোট ছোট কম্পন সেই সুপ্ত অংশগুলোকেই নেড়ে দিচ্ছে। তাঁর মতে, ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প শত বছর থেকে দেড়শ বছর পরপর একবার হওয়া স্বাভাবিক চক্র। বাংলাদেশ সেই চক্রের গভীরেই দাঁড়িয়ে আছে। আর ঢাকার ২৫ শতাংশ ভবন এমনিতেই ভূমিকম্প-সহনশীল নয়।
সবচেয়ে উদ্বেগের তথ্য এসেছে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট থেকে। ১৮৮৫ সালে মধুপুর ফল্টে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার কম্পন হয়েছিল। তার পর ১৩৯ বছর বড় ধরনের কোনো কম্পন হয়নি। যদি ওই রেখায় এখন ৬ দশমিক ৯ মাত্রার কম্পন হয়, ঢাকায় ধসে পড়বে অন্তত ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন। কম্পন দিনে হলে মৃত্যু দুই লাখের বেশি; রাতে হলে তিন লাখেরও বেশি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আসলে এই দেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিত জাতীয় নীতিই নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু কাজ চলছে। কিন্তু একটি স্পষ্ট নীতিপত্র ছাড়া ভবন নির্মাণ থেকে নগর পরিকল্পনা; কোনো কিছুই কাঙ্ক্ষিত পথে যাচ্ছে না।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ১৩টি অঞ্চলকে ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ বলছে। বিশেষ করে সিলেটের জৈন্তাপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। সেগুলো ঢাকার শত কিলোমিটার দূরে হলেও ৭-৮ মাত্রার কম্পন ঢাকাকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাকা শহরে জনসাধারণের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ও খোলা জায়গার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে মানুষ যখন হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে একটু নিরাপদ বা খোলা জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন অধিকাংশ এলাকায়ই সেই খোলা জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকা শহর এমনভাবে তৈরি ও সম্প্রসারিত হয়েছে, অধিকাংশ এলাকায়ই ফাঁকা জায়গা নেই। যেগুলো ছিল সেগুলোও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ফলে ভূমিকম্প বা বড় কোনো বিপর্যয়ের সময় যেখানে গিয়ে মানুষ দাঁড়াতে পারবে, তেমন জায়গা অধিকাংশ এলাকায়ই অনুপস্থিত।তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনার মৌলিক ব্যাকরণ অনুযায়ী প্রতিটি এলাকাতেই হাঁটার দূরত্বের মধ্যে একটি খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা থাকা প্রয়োজন। এসব স্থান দুর্যোগের সময় কমিউনিটি স্পেস হিসেবে কাজে লাগতে পারে। নগর পরিকল্পনার প্রাথমিক নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে ৫০০ থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে একটি খোলা জায়গা এবং গ্রিন স্পেস বা পার্কের সুবিধা দিতে হবে। ঢাকার মতো জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় এই দূরত্ব অবশ্যই ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকার কথা।