NEWSTV24
ভূমিকম্প হয়, আলোচনা হয়, প্রস্তুতি নেওয়া হয় না
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:১৮ অপরাহ্ন
NEWSTV24

NEWSTV24

দেশে গত শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে মানুষ অনেকটাই আতঙ্কিত। ভূমিকম্প নিয়ে সবার মনে নতুন করে উৎকণ্ঠা ভর করেছে। দেশের ভেতরেই ঘন ঘন কম্পন দিচ্ছে বড় ভূমিকম্পের বার্তা। কিন্তু যতবারই ভূমিকম্পের কাঁপুনি হয়, তখন চলে আলোচনা। সপ্তাহ না ঘুরতেই থেমে যায় সবকিছু।ঘন বসতিপূর্ণ ঢাকা নগরীর ঝুঁকি কমাতে এর আগে বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও এগুলোর বেশির ভাগই দেখেনি আলোর মুখ। যে কোনো সময় প্রাকৃতিক এ দুর্যোগটির আঘাতের শঙ্কা থাকলেও মোকাবিলায় নেই প্রস্তুতি। সরকারি তরফে মোটামুটি প্রস্তুত বলা হলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাও লেজেগোবরে।জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র। যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়ছে। দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। নেই মহড়া কিংবা সচেতনতামূলক কোনো কার্যক্রম। বড় ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রযুক্তিতে সক্ষমতা শূন্যের ঘরে। উদ্ধার অভিযানে সক্ষমতার ঘাটতি ফায়ার সার্ভিসেরও। আবার ভূমিকম্পে আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গা নেই ঢাকায়। গত শুক্রবারের ভূমিকম্পে হতাহত সবাই বাসার বাইরে ছিলেন।

এ অবস্থায় পরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরির পাশাপাশি প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ভূতত্ত্ব ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। ভুল উৎপত্তিস্থলের তথ্যে জনমনে বিভ্রান্তি যে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকম্পের উৎস, মাত্রা আর ঝুঁকি শনাক্ত করার কথা, সেই বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। গত শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটের ভূকম্পনের পর তারা প্রথমে উৎপত্তিস্থল দেখায় গাজীপুরের বাইপাইল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেই তথ্য বদলে হয়ে যায় নরসিংদীর পলাশ। একই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের ভূমিকম্পে একই চিত্র। প্রথমে ওয়েবসাইটে দেখানো হয় উৎপত্তিস্থল ঢাকার বাড্ডা। দুই ঘণ্টা পর আবার পরিবর্তন করে দেখানো হয় নরসিংদী-ঢাকা অঞ্চল। ফলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।আগারগাঁওয়ে ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্থাটির ১০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও সারাদেশের ডেটা বিশ্লেষণ ও গবেষণার দায়িত্ব পড়েছে মাত্র একজন আবহাওয়াবিদ এবং একজন সহকারী আবহাওয়াবিদের ওপর। পর্যাপ্ত জনবল নেই; নেই আধুনিক সফটওয়্যার বা তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ সুবিধা। পুরো ব্যবস্থা চলে কোনো রকম জোড়াতালিতে।বিশেষজ্ঞদের মত, ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের জন্য দ্রুত, নির্ভুল পর্যবেক্ষণ অত্যাবশ্যক। অথচ মূল কেন্দ্রই যদি ভুল তথ্য দেয়, তাহলে জরুরি সাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ঝুঁকির মুখে পড়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, এগুলো কোনো কারিগরি ত্রুটি নয়। ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফল দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়। প্রাইমারি ওয়েভ থেকে সেকেন্ডারি ওয়েভ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই প্রাথমিক তথ্য ভুল হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। আশ্রয় নেওয়ার মতো খোলা জায়গা নেই গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ বাসায় ছিল। হঠাৎ দুলতে থাকা ভবন টের পেয়ে অনেকে আতঙ্কে নিচে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এখানেই দেখা দিল আরেক বিপদ নেই খোলা জায়গা। অনেকেই বাসার সামনের সরু গলি বা সড়কে দাঁড়িয়ে রইলেন, যার দুই পাশেই উঁচু ভবন। কেউ নিরাপদ দূরত্বে যেতে চাইলেন, কিন্তু সেই জায়গা নেই। যারা নিহত বা আহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ভবনের বাইরে ছিলেন।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকায় নিরাপদ ও খোলা জায়গার ঘাটতি এত ভয়াবহ যে, মানুষের আতঙ্কিত দৌড়াদৌড়ি শেষ পর্যন্ত বিপদের ঝুঁকি আরও বাড়ায়।

তাঁর ভাষায়, ঢাকার গড় জনঘনত্ব বিবেচনায় প্রতিটি এলাকার হাঁটা-দূরত্বে একটি খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা থাকার কথা। নগর পরিকল্পনায় এটি মৌলিক নীতি। আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শ শহরগুলোয় নাগরিকদের ৫০০ থেকে ৮০০ মিটারের মধ্যে একটি পার্ক, গ্রিন স্পেস বা ওপেন স্পেস নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। ঢাকার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব আরও কম হওয়া উচিত।যে জায়গাগুলো এক সময় খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা ছিল, সেগুলো বছর বছর বদলে গেছে নির্মাণ প্রকল্পে। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নিজেই বলছে, ঢাকায় খোলা জায়গা ও মাঠের সংকট প্রকট। সবুজ এলাকা থাকা উচিত শহরের মোট এলাকার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ঢাকায় তা ৫ শতাংশের নিচে।আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, খোলা জায়গা তৈরি করা ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা আর উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। শহরের ভবন ধসে পড়লে ধ্বংসাবশেষ সরানো থেকে উদ্ধার পর্যন্ত সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানেই সবচেয়ে বেশি শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে।