আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আজ সর্বজনীন পেনশনের নিবন্ধন এক লাখ ছাড়াল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্কুল-মাদরাসা বন্ধ রাখতে হাইকোর্টের নির্দেশমহাবিপদ এড়াতে এখনই সাজাতে হবে পরিকল্পনা ২৭ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বন্ধ থাকবে আজ
No icon

গ্রিন কোজিতে একটি চুলাও ব্যবহারের অনুমতি ছিল না

চেয়ার-টেবিল পুড়ে অঙ্গার। ছাই হয়ে গেছে আসবাব। গ্যাসের সিলিন্ডার পড়ে আছে এলোমেলো। কোনোটির গায়ে ধোঁয়ার কালো আস্তরণ। কিছু সিলিন্ডার আবার পুরোপুরি অক্ষত। ফ্রিজের ভেতরে কোমল পানীয় ও বোরহানির বোতলগুলো দগ্ধ হয়ে কুঁকড়ে গেছে। রেস্তোরাঁর নানা খাবার সামগ্রী অঙ্গার। কোনটি সিরামিকের, কোনটি কাচের থালা চেনা দায়। বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের অন্দরমহলে বিভীষিকার ছাপ। সাত তলাজুড়েই যেন ধ্বংসস্তূপ। ব্যতিক্রম কেবল বহুতল ভবনটির ছাদ। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোনসেটের কভার। ওই ভবন থেকে যে ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশ ছাদে গিয়ে ছোট্ট একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।বেঁচে যাওয়া অনেকে জানান, আগুন লাগার পর কোনো অ্যালার্ম বাজেনি। তাই ভবনটির বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁয় যারা প্রিয়জনের সঙ্গে খাবার খেতে ব্যস্ত ছিলেন, তাদের কাছে অনেকক্ষণ পর আগুন লাগার খবর পৌঁছে। ততক্ষণে ভবনের সরু সিঁড়িতে ধোঁয়া ও আগুনের কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেকে চেষ্টা করেও ছাদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। গ্রিন কোজির অনেক রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার ও চুলা ব্যবহারের অনুমতিই ছিল না।

এদিকে, গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ভবনটির মালিক প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় ভবনটির নিচতলার ফাস্টফুড চা চুমুকে র কর্ণধার আনোয়ারুল হক (২৯), কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেল সিরাজ (৩৪) এবং ভবনের ব্যবস্থাপক মুন্সি হামিমুল আলম বিপুলকে (৪০) আসামি করা হয়েছে। হত্যাচেষ্টা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে গত রাতে রমনা থানার উপপরিদর্শক শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন।মামলার এজাহারে বলা হয়, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের পক্ষে গ্রিন কোজি কটেজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মুন্সি হামিমুল আলম। নিয়ম ভেঙে ভবনটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। আসামিরা অবৈধভাবে সেখানে রেস্টুরেন্ট খুলে ব্যবসা করছিলেন। রাজউকের দোকান পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে তারা এটা করেছিলেন। ম্যানেজ হওয়ার পরই ওই ভবনে রেস্তোরাঁ খোলা, গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহারের সুযোগ পান তারা।

আগুন লাগার কারণ হিসেবে এজাহারে বলা হয়, ভবনটির নিচতলায় থাকা রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগে পরে তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। যথাযথ সতর্কতা না নিয়ে গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো সেখানে মজুত করে রাখা হয়েছিল।প্রাথমিকভাবে আরও জানা যায়, ভবনটি আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হলেও পরে বিভিন্ন তলায় ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বাণিজ্যিক সনদ নেওয়া হয়। রেস্তোরাঁর মালিকরা রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলা ব্যবহারে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনুমতি নেননি। রেস্তোরাঁয় অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ অন্য ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতি ছিল না। এমনকি ভবনটিতে ফায়ার এক্সিট সিঁড়িও নেই।পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রিন কোজির মালিক ও ব্যবস্থাপক নিয়ম না মেনে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ভাড়া দিয়েছিলেন।পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান ডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগুন লাগার পর পুরো ভবনটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। ধোঁয়া বের হওয়ার মতো কোনো জায়গা সেখানে ছিল না। এ ছাড়া ভবনের বৈদ্যুতিক লাইন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।রমনা থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে ভবন ঘিরে যেসব অনিয়ম পাওয়া গেছে, এর ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। চারজনকে ধরা গেছে। আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ অভিযানে রয়েছে।

শনিবার বেইলি রোডে গিয়ে দেখা যায়, গ্রিন কোজি ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। আগুন পোড়া ভবনটি ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছিলেন। গতকাল থেকে বেইলি রোডের কিছু দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। তবে অনেকের চোখে-মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ। গ্রিন কোজির পাশের ভবনের বাসিন্দা ফাতেমা ইয়াসমিন তামিম বলেন, আগুন লাগার পর আমাদের ভবনেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তাড়াহুড়া করে অনেকে বাসা থেকে নেমে আসেন। একই ভবনের রেস্তোরাঁ, মানুষের বাস ও মার্কেট অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অনিয়মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। যারা এসব দেখভাল করবে, তারা যদি টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ হয়, তাহলে দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না।পাশের ভবনের আরেক বাসিন্দা হারিছুর রহমান শোহান জানান, গ্রিন কোজির সাত তলার ছাদ বরাবর তাঁর বাসা। আগুন লাগার পর পাশের ভবনের ধোঁয়া তাঁর বাসায় আসতে শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি বাসা থেকে নেমে আসেন।ফায়ার সার্ভিস ও রেস্তোরাঁ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে প্রবেশ রাস্তা ছিল একটি। সেটি নিচতলার চা চুমুক নামে ফাস্টফুড লাগোয়া। নিচতলায় রয়েছে দুটি লিফট ও একটি সরু সিঁড়ি। সিঁড়িটি এত সরু, সেখান দিয়ে চারজন লোক একসঙ্গে ওঠানামা করা যায় না। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী, চা চুমুক থেকে আগুনের সূত্রপাত। এর পর দোকানকর্মীরা শুরুতে তা নেভানোর চেষ্টা করেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় গ্রিন কোজির পঞ্চম তলায় দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে জেস্টি নামে একটি রেস্তোরাঁয় ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, রাত ১০টার দিকে আগুন লাগার বিষয়টি আঁচ করতে পারি। তখন ওই রেস্তোরাঁয় ১০-১২ জন ছিল। আগুন লাগায় চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে ছাদে উঠে যাই। ১-২ মিনিট দেরি হলেই প্রাণ বাঁচানো কঠিন হতো। ফায়ার অ্যালার্ম না বাজায় অনেকে দেরিতে আগুন লাগার খবরটি জানতে পারি। ঘটনার পরপরই অ্যালার্ম বাজলে হতাহত কম হতো।

এদিকে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় করা মামলায় কাচ্চি ভাইয়ের ব্যবস্থাপক ও চা চুমুকের দুই মালিকসহ চারজনের প্রত্যেকের দু দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তারা হলেন কাচ্চি ভাইয়ের ব্যবস্থাপক জিসান, চা চুমুকের মালিক আনোয়ারুল হক ও শাকিল আহমেদ রিমন এবং গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ব্যবস্থাপক হামিমুল হক বিপুল। শনিবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এর পর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মামলার রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনছার মিলটন তাদের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা চৌধুরী দু দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।অগ্নিকাণ্ডের পরপরই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, যে ভবনে আগুন লেগেছিল, তার একতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভবনের অনুমতি থাকলেও সেখানে রেস্টুরেন্ট বা শোরুম করার অনুমোদন ছিল না। অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন ছিল। বিনা অনুমতিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভবনটিতে রেস্তোরাঁ খোলা হয়। সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে এসব রেস্তোরাঁয় রান্নাবান্না করা হতো। নিয়মিত তদারকির অংশ হিসেবে তিন দফায় ভবন মালিককে তিনবার নোটিশ দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শুধু নোটিশ দিয়ে তারা এ দায় এড়াতে পারেন না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে সেখানে অভিযান চালানো যেত। রেস্তোরাঁ বন্ধ ও ভবন মালিককেও জরিমানা করা জরুরি ছিল। এমনকি গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় এফিবিসিসিআইর একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যরাও বলেছেন, কেবল নোটিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রকরা আগুনের দায় এড়াতে পারেন না।