যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পেলো হামাসঝুম বৃষ্টিতে স্বস্তি ফিরলো সিলেটেজলবায়ু পরিবর্তনজনিত কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশতানজানিয়ায় ভারী বৃষ্টি-ভূমিধসে নিহত ১৫৫মাসের শুরুতে বৃষ্টির আভাস, গরম কমা নিয়ে সংশয়
No icon

ইসলামী শিল্পকলায় রঙের প্রতীকী ব্যবহার

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইসলামী শিল্প-কলা ও স্থাপত্যের অস্তিত্ব রয়েছে। ইসলামী শিল্প ও স্থাপত্য যেমন তার শৈলী ও নান্দনিকতায় স্বতন্ত্র, তেমনি এতে রঙের ব্যবহারও ব্যতিক্রম। রঙের প্রতীকী ব্যবহার ইসলামী শিল্পকলা ও স্থাপত্যকে নিজস্বতা দান করেছে। শিল্পশৈলী ও রঙের ব্যবহারে পূর্ববর্তী রোমান, বাইজেন্টাইন ও পারস্য সভ্যতার প্রভাব থাকলে ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক দর্শনই এর মূল ভিত্তি। 

ইসলামী শিল্পকলায় রঙের প্রতীকায়ন

ইসলামী শিল্পকলা ও স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি রঙের তাৎপর্য তুলে ধরা হলো।

১. সবুজ : ইসলামী সভ্যতায় সবুজ একটি পবিত্র রং, যা নৈস্বর্গিক পৃথিবী ও জান্নাতের প্রতি ইঙ্গিতবাহী। মুসলিম ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী জান্নাতিদের পোশাকের রং হবে সবুজ। মসজিদে বহুল ব্যবহৃত একটি রং সবুজ। যা চার পাশের সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ তৈরি করে। সবুজ রংটি মুসলিম উম্মাহকে মসজিদে নববীর গম্বুজের কথা মনে করিয়ে দেয়, মুমিনের হৃদয়ে নবীপ্রেম জাগ্রত করে।

২. নীল : নীল রংকে মনে করা হয় আধ্যাত্মিকতা ও জান্নাতের প্রতীক। নীল আধ্যাত্মিক মগ্নতা ও ধ্যানের প্রতি ইঙ্গিত করে। ইসলামী স্থাপত্যে টালি, গম্বুজ ও ছাদের অভ্যন্তর ভাগের কারুকাজে ব্যবহৃত হয়। নীল রংটি মহাবিশ্বের অন্তহীন গভীরতাকেও ধারণ করে। গাঢ় নীল জলের রহস্যময় জগতের প্রতি ইঙ্গিত করে। নীল আকাশ বা আসমানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে আল্লাহর আরশ অবস্থিত। সাধকদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য ও কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানের দূরতম গন্তব্যের অনুস্মারক নীল। তুরস্কের সুলতান আহমদ মসজিদ (বা ব্লু মসজিদ) ও ইরানের শাহ মসজিদে নীল রঙের প্রতীকায়ন হয়েছে।

৩. সোনালি : সোনালি ঐশ্বরিক পবিত্রতা ও আভিজাত্যের রং। সভ্যতা-সংস্কৃতিতে সোনালি সম্পদ, মর্যাদা ও রাজকীয়তার প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামী সভ্যতায় সোনালি দিয়ে বোঝানো হয় ঈমান, ঈমানি ঐশ্বর্য ও তাঁর গুরুত্ব। সোনালি রং শাশ্বত মূল্যবোধেরও প্রতীক। সোনালি রং মহিমা ও গৌরব বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। সোনালি রং মুসলমানদের জেরুজালেমের আল আকসায় অবস্থিত ডোম অব দ্য রকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম জাতির কাছে ১৩ শ বছর আগে নির্মিত গম্বুজটি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।

৪. সাদা : ইসলামসহ প্রায় সব ধর্মেই পূতঃপবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। একই সঙ্গে তা সরলতা ও নম্রতাকে বোঝায়। সাদা রং ভদ্রতা, শালীনতা ও হৃদয়ের পরিশুদ্ধিকে ধারণ করে। সাদা ইসলামের শাশ্বত শান্তির বাণীকে ব্যক্ত করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা দেয়। ধর্মীয় স্থাপত্যের সাদা রং ইবাদতকারী ও সাধকের অন্তরে ভক্তি ও প্রশান্তি জাগিয়ে তোলে।

৫. কালো : ইসলামী সভ্যতায় কালো রঙের প্রতীকায়নে বৈপরিত্য রয়েছে। একদিকে সুফি সাধকদের একটি দল কালো রংকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করে। কেননা পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ, হাজরে আসওয়াদ ও নবী করিম (সা.)-এর ঝাণ্ডার রং কালো। অন্য একদল মনে করে, কালো পাপের প্রতীক। কেননা হাদিসে এসেছে, কেউ পাপ করলে অন্তরে কালো দাগ পড়ে। ফলে তাদের মতে কালো পাপ, বিশ্বাসঘাতকতা, অভিশাপ, অপরাধ, দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা ও মৃত্যুর বার্তা বহন করে।

৬. হলুদ : হলুদ রঙের প্রতীকায়নেও বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একদিকে হলুদ যেমন দুর্বলতা, অসুস্থতা, নির্বুদ্ধিতা, প্রবৃত্তি, ক্ষয় ও রোগের প্রতীক, তেমনি হলুদ দ্বারা স্বাধীনতা, সজীবতা, সামর্থ্য, যৌবন ও উত্ফুল্লতাও বোঝায়।

৭. রুপালি : রুপালি রংটি সোনালি রঙেরই মর্ম ধারণ করে। যদিও তা কিছুটা দুর্বলভাবে ব্যক্ত করে।

৮. লাল : লাল রং দ্বারা আগুন, উত্তাপ, রুক্ষতা বোঝায়। লাল দ্বারা শক্তির তীব্রতাও বোঝানো হয়। লাল মানুষের বিপজ্জনক প্রবণতাও বোঝায়। বিপরীতে লাল দ্বারা কখনো কখনো সৌন্দর্য, ঐশ্বর্যমণ্ডিত রত্ন পাথর, নতুন প্রভাত ও ফুলেল বসন্তের প্রতীকায়নও করা হয়।

ইসলামী সভ্যতার নানা পর্বে রং

ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলোর মধ্যে মৌলিকভাবে মিল থাকলেও অঞ্চলভেদে তাতে রঙের ব্যবহারে ভিন্নতা আছে। গবেষকরা মনে করেন, অঞ্চলভেদে ইসলামী সভ্যতায় রঙের ব্যবহার ভিন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষের জীবনযাত্রা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বৈচিত্র্য এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া প্রতিটি অঞ্চলের ইসলাম-পূর্ব সভ্যতাও নানাভাবে ইসলামী শিল্পকলাকে প্রভাবিত করেছে। যেমন—

১. আরব অঞ্চল : আরব অঞ্চলেই ইসলামের আগমন ঘটেছিল এবং এ অঞ্চল থেকেই ইসলামী সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। ফলে ইসলামী শিল্পকলার আরবীয় ধারার প্রভাব অন্যান্য অঞ্চলের ওপর সবচেয়ে প্রবল। আরব অঞ্চল বলতে, আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে ইরানের আরবি ভাষাভাষী অঞ্চল এবং মিসরসহ আফ্রিকার আরবি ভাষাভাষী অঞ্চল উদ্দেশ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামী শিল্পকলায় রঙের সচেতন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। যেমন প্রাথমিক পর্যায়ের শিল্পকলায় গাঢ় ও উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। যেমন নীল, সবুজ, গোলাপি, কফি, বেগুনি, লাল, কালো ও স্বর্ণালি। হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর পর আরব অঞ্চলে রঙের আদর্শ ব্যবহার শুরু হয়।

এ সময় মানুষের চেহারার আভাতে সোনালি রং প্রিয় হয়ে ওঠে। এটা করা হতো আভিজাত্য বোঝাতে। আব্বাসীয় আমলে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা পবিত্রকার প্রতীক হিসেবে কালো পোশাক পরিধান করত। ফাতেমি আমলে তা সাদায় রূপান্তরিত হয়। আইয়ুবীয় ও মামলুক আমলে ধর্মীয় পোশাক হিসেবে আবার কালো রং জনপ্রিয়তা পায়।

২. ভারতীয় উপমহাদেশ : ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শাসন করেছিল মোগল সম্রাটরা। মোগলরা ভারতবর্ষে একটি বিক্ষুব্ধ সময় পার করেছিল। কেননা ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যেমন বহু মত, মতাদর্শ, মতবাদ ও বর্ণে বিভক্ত ছিল, তেমনি মোগল শাসনের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়াও ছিল বিচিত্র। এই বিক্ষুব্ধতার প্রভাব পড়েছিল মোগল শিল্পকলায়। ফলে এ সময়ের শিল্পীরা গাঢ় রংগুলোই বেশি ব্যবহার করেছে। যেমন গাঢ় বাদামি, গাঢ় নীল, লাল, হলুদ ও কালো। তবে ভারতবর্ষের স্থিতিশীল মুসলিম রাজ্যগুলোতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন লাল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি, সোনালি ও নীল। যেগুলো সুখ, সমৃদ্ধি ও আনন্দের প্রতীক। এই অঞ্চলের রাজপরিবারের মুটুকসহ অন্যান্য পোশাকে সাদার ব্যবহার ছিল।

৩. মধ্যএশিয়া ও কুর্দি অঞ্চল : এই অঞ্চলে ইসলামী শিল্পকলার উন্নয়নকাল ধরা হয় সাফাবিদ শাসনামলকে। সাফাবিদ আমলের শিল্পীরা উন্নত রং ও শিল্পোপকরণ ব্যবহার করত। তারা রং নির্বাচন ও তার মিশ্রণে দক্ষতার পরিচয় দেয়। যদিও তারা সোনালি ও গাঢ় রঙের ব্যবহারই বেশি করেছিল। হিজরি একাদশ শতকে এই অঞ্চলে সুফি মতবাদের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে শিল্প-সাহিত্যে স্রষ্টার প্রেম ও তাঁর বিরহ নানাভাবে প্রস্ফুটিত হয়। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কালো রং এবং স্রষ্টার প্রতাপ বোঝাতে লাল রঙের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

৪. এশিয়া মাইনর : তুরস্কের উসমানীয় সুলতানরা এই অঞ্চল দীর্ঘ সময় শাসন করেন। উসমানীয় আমলের শিল্পীরা হালকা ও উজ্জ্বল রং বেশি ব্যবহার করত। তারা সুফি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। রঙের প্রতীকী ব্যবহারে তারা অত্যন্ত সচেতন ছিল। যেমন তারা শক্তি ও বিজয় বোঝাতে লাল রং, পার্থিব ও পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি বোঝাতে সবুজ, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা বোঝাতে নীল, পবিত্রতা বোঝাতে সাদা, আলো ও সুপথ বোঝাতে হলদে সোনালি রং ব্যবহার করত। উসমানীয় শিল্পীরা সচেতনভাবে কালো রং এড়িয়ে চলত।

৫. স্পেন তথা ইউরোপ : ঘর-বাড়ি ও বইয়ের পাণ্ডুলিপির অঙ্গসজ্জায় আগ্রহী ছিল স্প্যানিশ মুসলিম শাসকরা। তাদের চিত্রকলায় পশু-পাখির প্রকৃতিও দেখা যায়। এটা সম্ভবত ইউরোপীয় শিল্পকলার প্রভাব। তারা হালকা ও গাঢ় উভয় প্রকার রংই ব্যবহার করেছে। সাদা ছিল স্প্যানিশ মুসলিমদের সবচেয়ে প্রিয় রং। তারা এটাকে দুঃখের প্রতীক মনে করত। সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের ব্যবহার বেশি হতো। নারীদের স্কার্ফের প্রিয় রং ছিল লাল। তারা সীমিত পরিমাণে বাদামি ও কালো রং ব্যবহার করত।

তথ্যঋণ : প্রবন্ধ : সিগনিফিকেন্স অব কালারস ইন ইসলামিক আর্ট হিস্টোরি