রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রায় পিছিয়ে তৈরি পোশাক খাতঢাকাসহ ৫ বিভাগে বৃষ্টির আভাস, অব্যাহত থাকবে তাপপ্রবাহপ্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশুস্কুল-মাদ্রাসা খুলছে আজ, বন্ধ থাকছে ২৫ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানআজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
No icon

সূর্যঘড়ি নির্মাণকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আশ শাতির

আবুল হাসান আলাউদ্দীন আলী ইবনে ইবরাহীম আল আনসারী বা সংক্ষেপে ইবনে আশ শাতির বা ইবনে আশ শাতির (১৩০৪-১৩৭৫খ্রি.) ছিলেন একজন আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও প্রকৌশলী। তিনি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে একজন মুওাক্কিত (সালাতের সময়গুলো নির্ধারণের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করতেন এবং ১৩৭১ বা ১৩৭২ সালে তিনি মসজিদের মিনারের জন্য একটি সূর্যঘড়ি তৈরি করেন।

ইবনে আশ শাতির ছয় বছর বয়সে পিতৃহারা হন। এরপর তিনি দাদার কাছে লালিত পালিত হন। তার কাছ থেকেই তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আকর্ষিত হন। ইবনে আশ শাতির শিক্ষা অর্জনের জন্য কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় যান। আবু আলী আল মাররাকুশি এর কাছে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তিনি দামেস্কে ফিরে যান। এসময় উমাইয়া মসজিদে মুওাক্কিত হিসেবে তিনি নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তার মুওাক্কিত হিসেবে কাজের মধ্যে ছিলো দৈনিক পাঁচবার সালাতের সময় ও রমজান মাসের শুরু ও শেষ কবে তা নির্ণয় করা। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তিনি বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি নানা জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন এবং গাণিতিকভাবে তা মিলানোর চেষ্টা করেন। যা মসজিদের কাজের পাশাপাশি তার নিজের গবেষণাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি তার এই গবেষণা একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ছক আকারে লিখে রাখেন। যদিও এই ছক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর লেখা ইবনে আশ শাতিরের লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল কিতাব নিহায়াত আল সুল ফি তাসহিহ আল উসুল’ (প্রচলিত নিয়মের সংশোধনের জন্য শেষ অভিযান)। এই বইয়ে তিনি ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেলের চাঁদ, সূর্যের ও গ্রহের গতিপথের একটি বিরাট অংশ সংশোধন করেন। এখানে তিনি অতিরিক্ত এপিসাইকেল (Epicycle) সরিয়ে সেখানে তুসি যুগলের ব্যবহার করেন। তার এই মডেলটি পরবর্তীতে ১৬ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ইবনে আশ শাতিরের নাম উচ্চারিত হয় না। যদিও ইবনে আশ শাতিরের এই কাজটি ‘জুয আল জাদীদ’ (নতুন গ্রন্থ) –এ প্রকাশ করা হয়েছে কোপার্নিকাসের জন্মের প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে।

পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে ইবনে আশ শাতিরের কিছুটা পার্থক্য ছিল। যেমন- পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলেন দর্শনের ভিত্তিতে এবং অ্যারিস্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে। অন্যদিকে ইবনে আশ শাতির হিসাব মিলিয়েছিলেন বাস্তব জগতের প্রাপ্ত তথ্য থেকে। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আশ শাতিরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ফলেই তিনি ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেল হতে একটি এপিসাইকেল সরিয়ে দেন। এর ফলে পূর্বে দেওয়া যে কোনো মডেলের তুলনায় ইবনে আশ শাতিরের মডেল উন্নত প্রকৃতির ছিল। এটিই প্রথম মডেল ছিল যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল। তার এই কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের শাখায় একটি বিপ্লব ঘটিয়েছিল। যাকে ‘রেনেসাঁ যুগ পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ বলা যেতে পারে।

যদিও ইবনে আশ শাতিরের মডেলকে পৃথিবীর প্রথম মডেল হিসেবে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এর থেকে ইটালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। ইবনে আশ শাতির যে পদ্ধতিতে ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেলকে সংশোধন করেছিলেন। নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর বই ‘De revolutionibus’ ঠিক সে উপায়ই ছিল। কোপার্নিকাসের দেওয়া চন্দ্র ও শুক্রগ্রহের গতিপথ, ইবনে আশ শাতিরের মডেলের সাথে মিলে যায়। এসকল কারণে কিছু কিছু পণ্ডিত বলে থাকেন, কোপার্নিকাসের কাছে ইবনে আশ শাতিরের কাগজগুলো কোনোভাবে পৌঁছেছিল। কিছুকাল আগে বাইজেন্টাইনদের সময়কালে ইবনে আশ শাতিরের কাজের ন্যায় কাজ সমৃদ্ধ একটি পান্ডুলিপি ইতালি থেকে উদ্ধার করা হয়। এর ফলে ধারণা করা হয়, যখন পূর্ব থেকে জ্ঞান ধীরে ধীরে পশ্চিমে যাচ্ছিলো তখন কোপার্নিকাসের হাতে আসে ইবনে আশ শাতিরের কাজ। এই মহান জ্ঞানসাধক ১৩৭৫ সালে দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন।