রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রায় পিছিয়ে তৈরি পোশাক খাতঢাকাসহ ৫ বিভাগে বৃষ্টির আভাস, অব্যাহত থাকবে তাপপ্রবাহপ্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশুস্কুল-মাদ্রাসা খুলছে আজ, বন্ধ থাকছে ২৫ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানআজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
No icon

আধুনিক বিশ্বের পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক আল খাওয়ারেজমী

আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারেজমী ছিলেন একজন ফার্সি বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোলের ক্ষেত্রে সেইসময় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ৮২০ সালে তিনি বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ গ্রন্থাগারে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বীজগণিতের উপর আল-খাওয়ারেজমী 'জনপ্রিয়করণ" গ্রন্থটি রৈখিক এবং দ্বিঘাত সমীকরণের প্রথম পদ্ধতিগত সমাধান উপস্থাপন করেছিল। বীজগণিতে তাঁর অন্যতম প্রধান সাফল্য ছিল বর্গক্ষেত্র সম্পূর্ণ করে কীভাবে দ্বিঘাত সমীকরণগুলি সমাধান করা যায়। তার উপস্থাপন, যার জন্য তিনি জ্যামিতিক যৌক্তিকতা সরবরাহ করেছিলেন। তিনিই প্রথম বীজগণিতকে একটি স্বাধীন শৃঙ্খলা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তিনি "হ্রাস" এবং "ভারসাম্য" পদ্ধতি (বিয়োগকৃত পদগুলির একটি সমীকরণের অন্যদিকে স্থানান্তর, অর্থাৎ, সমীকরণের বিপরীত দিকের অনুরূপ পদ বাতিল করা) প্রবর্তন করেন। বীজগণিত শব্দটি তারই বইয়ের শিরোনাম থেকে এসেছে। আল-জাবের শব্দের অর্থ "সমাপ্তি" বা "পুনরায় যোগদান"। তার নাম অ্যালগোরিজম এবং অ্যালগরিদম শব্দের জন্ম দেয়, সেইসাথে স্প্যানিশ, ইতালীয় এবং পর্তুগীজ শব্দ অ্যালগোরিটমো, এবং স্প্যানিশ গুয়ারিস্মো এবং পর্তুগীজ আলগারিস্মো। যার অর্থ "ডিজিট"। 

দ্বাদশ শতাব্দীতে, পাটিগণিতের উপর তার পাঠ্যপুস্তকের ল্যাটিন অনুবাদ (অ্যালগরিদমো ডি নিউমেরো ইন্দোরাম) যা বিভিন্ন ভারতীয় সংখ্যাকে সংহিতাবদ্ধ করে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে দশমিক অবস্থানগত সংখ্যা ব্যবস্থা চালু করে। ১১৪৫ সালে রবার্ট অফ চেস্টার কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত কম্পেন্ডিয়াস বুক অন ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লিশন অ্যান্ড ব্যালান্সিং ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রধান গাণিতিক পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হত।

তিনি তার সর্বাধিক পরিচিত কাজ ছাড়াও ক্লডিয়াস টলেমি (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর ভূগোল সংশোধন করেন। বিভিন্ন শহর এবং এলাকার দ্রাঘিমাংশ এবং অক্ষাংশ তালিকাভুক্ত করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সারণির একটি সেট তৈরী করেন। ক্যালেন্ডারিক কাজ, সেইসাথে অ্যাস্ট্রোলাব এবং সূর্যালোক সম্পর্কেও তিনি লিখেছিলেন। তিনি ত্রিকোণমিতির সঠিক সাইন, কোসাইন টেবিল এবং স্পর্শকগুলির প্রথম সারণি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। 

আল খাওয়ারেজমী'র জন্ম তারিখ বা শৈশব ও কৈশোর সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে যতটুকু জানা যায়, তিনি রাশিয়ার আরব সাগরে পতিত আমু দরিয়া নদীর একটি দ্বীপের নিকটে অবস্থিত খোয়ারিজম নামক শহরে আনুমানিক ৭৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তখন এই শহরটি প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল যার তৎকালীন নাম ছিল উরগেঞ্চ।

খলিফা আল মামুন (৭৮৬-৮৩৩) মৃত্যুর ১৭ বছর পর ৮৫০ সালে আল খাওয়ারেজমী মৃত্যুবরন করেন।
আল খাওয়ারেজমী খলিফা আল মামুনের বায়তুল হিকমাহ সংলগ্ন গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিকের চাকুরী করতেন। খলিফা মামুনের মৃত্যুর পরও তিনি জীবিত ছিলেন। পরবর্তী খলিফা আল ওয়াতহিক (৮১২-৮৪৭) এর শাসনকালের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, ভূগোল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রাখেন। তবে মূলত বীজগণিতের জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন। এজন্য তাকে বীজগণিতের জনক বলা হয়। 

আল খাওয়ারেজমীর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছুই জানা যায় না। তার নাম থেকে অনুমান করা হয় যে তিনি সম্ভবত আব্বাসীয় শাসনামলে খোরাসান প্রদেশের খোয়ারিজমী (খিভা) হতে আগমন করেন। যা বর্তমানে উজবেকিস্থান এর জরাজম প্রদেশ হিসেবে পরিচিত।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল তাবারী (৮৩৯-৯২৩) তার নাম দেন মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারেজমী আল কুতরুবুল্লী। এই বিশেষণ আল-কুতরুবুল্লী এটাই নির্দেশ করে যে, তিনি সম্ভবত বাগদাদ এর নিকটবর্তী ক্ষুদ্র শহর কুতরুবুল এলাকা হতে এসেছেন। আল খাওয়ারেজমী'র ধর্ম সম্পর্কে টমুর লিখেছেন:

"আল তাবারী কর্তৃক তার উপর আরোপিত আরেকটি বিশেষণ হল, "আল-মাজুশী," এটাই নির্দেশ করে যে তিনি হয়তোবা প্রাচীন জরথ্রুস্ট (খ্রীস্টপূর্ব ১৭০০-১৫০০) মতবাদের অনুসারী ছিলেন। এটা ইরানীয় বংশোদ্ভূতদের ক্ষেত্রে তৎকালীন সময় পর্যন্ত অসম্ভব ছিল না। কিন্তু “এলজেবরা” গ্রন্থের মুখবন্ধ হতে দেখা যায় যে, আল-খাওয়ারেজমী ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান। অর্থাৎ আল তাবারী বিশেষণ এটাই নির্দেশ করে যে, হয়তোবা তাঁর পূর্বপুরুষ কিংবা তিনি সম্ভবত তাঁর কৈশোরে জরথ্রুস্ট মতবাদের অনুসারী ছিলেন"।

ইবনে আল নাদিম (৯৩২-৯৯৫) এর কিতাব “আল- ফিরহিস্ট” এ আমরা আল খাওয়ারেজমী'র একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী খুঁজে পাই। যেখানে তার লিখিত বই সমূহের একটি তালিকাও রয়েছে। আল- খাওয়ারেজমী তার অধিকাংশ গ্রন্থ ৮১৩ হতে ৮৩৩ সালের সময় কালের মধ্যে রচনা করেছেন। মুসলমানদের পারস্য বিজয় এরপরে বাগদাদ-ই ব্যবসা-বাণিজ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দূর-দূরান্ত এমনকি চীন ও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও প্রচুর ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী বাগদাদে পাড়ি জমান। অনুমান করা হয় যে, আল-খাওয়ারেজমীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি বাগদাদে খলিফা আল-মামুন এর গ্রন্থাগারে প্রধান গ্রন্থাগারিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞান এবং গণিত চর্চা করতেন। এখানে বসেই তিনি গ্রীক ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেক বৈজ্ঞানিক রচনা অনুবাদ করেন।

বীজগণিত হল ইসলামী সভ্যতায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। বীজগণিতকে তিনিই প্রথম গণিতশাস্ত্রের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলেন। এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারতীয়রাই প্রথম বীজগণিত নিয়ে গবেষণা করে। গ্রীকদের মধ্যে কেবল ডায়োফ্যান্টাস ব্যতীত আর কাউকে বীজগণিত নিয়ে খুব একটা চর্চা করতে দেখা যায় নি। ভারতীয়দের গাণিতিক উৎকর্ষের সময়টা অনেক প্রাচীন ছিল। সুতরাং খাওয়ারেজমী'র সময় বীজগণিতের অবস্থা ছিল ম্রিয়মান। এ সময় তিনি বীজগণিতের ভিত্তি স্থাপন করে আধুনিক গণিতের পথকে অনেকটাই কুসুমাস্তীর্ণ করে তোলেন।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিন্দু গণিতবিদগণ দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। হিন্দুদের উদ্ভাবিত এই দশমিক পদ্ধতি খাওয়ারেজমীই প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তার রচিত The Book of Addition and Subtraction According to the Hindu Calculation (যোগ-বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) গ্রন্থটি তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আরবী ভাষায় তার রচিত গ্রন্থই সর্বপ্রথম ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতায় ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমেই তার গবেষণার বিকাশ ঘটে। অ্যালগরিদম উৎপত্তিই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর রচিত পুস্তক "কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবলা" হতে বীজগণিতের ইংরাজী নাম "আলজেবরা" উৎপত্তি লাভ করেছে।

অ্যালগরিদম শব্দটি খোয়ারেজমী নামের ল্যাটিন অপভ্রংশ। যা (algorismi) "অ্যালগরিজমি" হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। আল খাওয়ারেজমী পাটিগণিতেও অসামান্য পারদর্শী ছিলেন। তিনিই প্রথম শূণ্য (০) সহ অন্যান্য সংখ্যার ব্যবহার শুরু করেন। তাঁর মাধ্যমেই ইউরোপ শূণ্যের ব্যবহার শিক্ষা লাভ করে।

জ্যােতির্বিজ্ঞানে আল খাওয়ারেজমি একটি স্মরণীয় নাম । এ শাস্ত্রে তিনি বহু মৌলিক অবদান রেখে গেছেন। তাঁর রচিত 'নির্ঘণ্ট' প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর সাহায্যে ইবনে আলী জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর পর্যবেক্ষণ চালান। এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন হয়। আল ফারগণী (৮০০-৮৭০) তাঁর যুগের একজন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর রচিত 'জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার' (Elements of Astronomy) ক্রিমেনার জিয়ার্ড ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। আল খাওয়ারেজমী রচিত সুরত-আল-আরথ (The image of the Earth) গ্রন্থটি বিশ্বের প্রথম মানচিত্র হিসেবে বিবেচিত।

আল খাওয়ারেজমী ক্যালেন্ডার পদ্ধতি নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি হিব্রু বর্ষপঞ্জি নিয়ে 'রিসালা ফি ইসতিখরাজ তারিখ আল ইয়াহুদ' (Extraction of the Jewish Era) শিরোনামের একটি বই রচনা করেন। সপ্তাহের কোন দিন মাসের প্রথম দিন হবে তা নির্ণয়ের উপায় তিনি এতে বর্ণনা করেন। এটি ‘তিশ্রি’ নামেও পরিচিত। এছাড়াও তিনি ইহুদি বর্ষ বা ‘অ্যানো মুন্ডি’ এবং ‘অ্যানো গ্রেকোরাম’ বা গ্রীক বর্ষের মধ্যকার বিরামকাল নির্ণয় করেন। হিব্রু পঞ্জিকা ব্যবহার করে সূর্য ও চাঁদের দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করা নিয়েও এতে তিনি আলোচনা করেছিলেন।