
কোনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহায়তা করা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার আগে একটি সুবিন্যস্ত জনপ্রশাসন খুবই জরুরি। কারণ জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব। নির্বাচনে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে জনপ্রশাসনে। সরকার ও ইসির ঘোষণা মতো জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ১২০ দিন সময় বাকি থাকলেও প্রশাসনের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। নির্বাচনে সহযোগিতা দূরে থাক, নিজেই যেন চলতে পারছে না প্রশাসন। দুই সপ্তাহ ধরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ ফাঁকা পড়ে আছে। প্রত্যাহার করা হয়নি যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া জেলা প্রশাসকদের। বিভিন্ন স্থানে ডিসি পদে পদায়ন করলেও বিতর্কের জেরে আবার প্রত্যাহার করতে হয় আগের প্রজ্ঞাপন। শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের অভাবে পদে পদে সংকটে পড়ছে প্রশাসন।প্রশাসন চালাতে গিয়ে রীতিমতো সংকটে আছে অন্তর্বর্তী সরকার। তদবির ও চাপ সামলাতে পারছে না। অদক্ষতার ছাপ সামনে আসছে প্রতিনিয়ত। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত ৫ সেপ্টেম্বর ওএসডি থাকা উপসচিবদের পদায়নের ঘটনা। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটিতে (সাবেক সিপিটিইউ) শূন্যপদের অতিরিক্ত পদায়ন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তা ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমপক্ষে ২০ জন ডিসি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার সাত মাস পরও জেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। আবার সচিবসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দিতে গিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে দফায় দফায়। গেল সরকারের অন্যায্য সুবিধাভোগী হিসেবে সমালোচনা সামনে এলে পরক্ষণে ওএসডি করে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিঞা আমাদের সময়কে বলেন, জনপ্রশাসনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। প্রশাসনের সব স্তরে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এমনটা আগে কখনও ঘটেনি। বর্তমান সরকারের আমলে এমন করুণ অবস্থা আশা করেনি কেউ। আগামীতে কেমন হবে তাও বলা যাচ্ছে না।সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রশাসনের সর্বস্তরের ভূমিকা জরুরি। কিন্তু এ মুহূর্তে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। দলীয় চাপ থেকে মুক্ত করা যায়নি প্রশাসনকে। পদোন্নতি ও বদলিতে নেই গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে পছন্দের কর্মকর্তাকে পদায়ন নিয়ে ক্ষোভ ও বিতর্ক কাটছে না। তা ছাড়া পদোন্নতি বা ফিটলিস্টের জন্য সংস্থার মাধ্যমে গোপন প্রতিবেদনের চর্চিত পন্থা নিয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, চাকরির পর কোনো কর্মকর্তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানদার বা প্রতিবেশীর অভিমত নেওয়া হয়। সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বলা হয় একে। আত্মীয়ের পরিচয় বা অবস্থানের জেরে নিরীহ কর্মকর্তাকে খেসারত দেওয়ার দৃষ্টান্ত নতুন নয়। বরং কর্মক্ষেত্রে তার ভূমিকাকেই বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ বিভাগের কাছে গোপনীয় প্রতিবেদন চাওয়া হয়। আবার পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। জনপ্রশাসনে রাজনীতিকীকরণ এ স্তর থেকেই শুরু হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন মনে করে, এ নিয়ম বাতিল হওয়া প্রয়োজন।
জনপ্রশাসনে দলীয়করণের ধাপটা দৃশ্যমান হয় জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকের ঘটনা। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, এইচটি ইমাম, আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানদের হাত ধরে দলীয়করণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। দেখা গেছে, ডিসি নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সবাইকে নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে।দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে দলীয় লোকদের নিয়োগ ও দলীয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান, সরকারি কর্মকাণ্ডে প্রায় সব আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আইনানুগ সিদ্ধান্তের পরিবর্তে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায়। এর ফলে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হওয়া ও দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।