
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিদেশগমন দিন দিন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। একের পর এক দেশ বাংলাদেশিদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বাতিল করে দিয়েছে, সীমিত করে দিয়েছে ট্যুরিস্ট ভিসার সুযোগও। ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, এমনকি শ্রীলংকার মতো তুলনামূলক ছোট ও পর্যটননির্ভর দেশগুলো পর্যন্ত এখন বাংলাদেশিদের জন্য কঠোর শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। নতুন দেশও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যেসব দেশ এখনও কিছু ভিসা দিচ্ছে, তারা আবেদন যাচাইয়ে অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে। কোথাও বা বিনা ব্যাখ্যায় প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে শত শত আবেদন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য বিশ্ব এখন এক অনিশ্চয়তার গন্তব্য।পর্যটন ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব দেশের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশিদের মধ্যে ট্যুরিস্ট ভিসার অপব্যবহার, অবৈধ অভিবাসন ও অপরাধপ্রবণতার অভিযোগে উদ্বিগ্ন। ফলে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতা এবং দীর্ঘদিনের গাফিলতির কারণেই এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।কিছুদিন আগেও ভারত ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজগম্য গন্তব্য। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বন্ধ আছে ভারতের ভিসা কার্যক্রম। ভারতে না যেতে পারার প্রভাব পড়েছে নেপাল ও ভুটানের মতো অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও, যেগুলোতে ভারত হয়ে যাওয়া যেত সহজেই। পর্যটকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা দেশ ভিয়েতনামও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে।
কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, অনেক বাংলাদেশি পর্যটক ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও দেশে ফেরেননি। কেউ থেকে গেছেন অপ্রত্যাশিতভাবে, কেউ আবার পাড়ি দিয়েছেন অবৈধ পথে অন্য দেশে। একই ধরনের কারণে ইন্দোনেশিয়াও তিন বছর ধরে বাংলাদেশিদের অন-অ্যারাইভাল সুবিধা বন্ধ রেখেছে। দেশটি দাবি করেছে, মানব পাচারকারীরা ইন্দোনেশিয়াকে ব্যবহার করছিল অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার রুট হিসেবে।বাংলাদেশ বারবার অন-অ্যারাইভাল সুবিধা চালুর অনুরোধ জানালেও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান বদলায়নি। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার ভিসা পেতে হলে যাচাই-বাছাইয়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং অনুমোদন পেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস।উজবেকিস্তান- যেটি কিছুদিন আগেও বাংলাদেশিদের জন্য ইলেকট্রনিক ভিসা দিত, সেটিও সেই তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দিয়েছে। থাইল্যান্ড ৫ মে থেকে কার্যত বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রেখেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- যেসব ভ্রমণকারীর ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল, তাদের ভিসা আবেদনও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। অল্প কিছু ভিসা হলেও পেতে সময় লাগছে দেড় মাস পর্যন্ত।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, বিশেষ করে দুবাই। বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কার্যত বন্ধ রেখেছে দেশটি। যদিও প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৫০টি ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে, তবে সেটি মূলত ব্যবসায়িক বা বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য; সাধারণ পর্যটকরা এর আওতায় নেই। ফিলিপাইনের ভিসা আগে ১০ দিনে মিললেও এখন সময় লাগছে দেড় মাস পর্যন্ত। মালয়েশিয়া, কুয়েত, বাহরাইন ও কাতারেও ভিসা প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে।বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য ইউরোপের সেনজেন জোনভুক্ত দেশগুলোতেও কড়াকড়ি বেড়েছে। আবেদন জমা দেওয়ার পর সাক্ষাৎকার ও অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত; বেড়েছে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হারও। বর্তমান ৭০-৮০ শতাংশ আবেদনই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ভিসার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আবেদনকারীরা মাসের পর মাস অপেক্ষার পরও সাক্ষাৎকারের তারিখ পাচ্ছেন না। অনেকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরও কোনো ফল পাচ্ছেন না।বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরব বর্তমানে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের জন্য ওয়ার্ক, পারিবারিক, ব্যবসা ও ওমরাহ ভিসায় সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও বন্ধ রয়েছে। ইতালির কাজের ভিসা পাওয়ার জন্যও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেও কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে চাহিদামতো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এই ভিসা সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের আউটবাউন্ড ট্যুরিজমে। ট্রাভেল এজেন্সি কোম্পানি অওরটেক ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল আলম বলেন, এ সংকট দীর্ঘায়িত হলে দেশের আউটবাউন্ড ট্যুরিজম কার্যত ধ্বংস হয়ে যাবে। হাজার কোটি টাকার এ বাজারে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি বিদেশভিত্তিক এয়ারলাইন্স, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিগুলোতেও বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য আগ্রহ কমে যাচ্ছে।ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মোহাম্মদ রাফিউজ্জামান বলেন, আমরা এখন বড় ধরনের সংকটে পড়েছি। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই, উজবেকিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান ও কাতার- এসব দেশের ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ- এ চারটি দেশ কিছুটা খোলা রয়েছে। তাও সীমিত। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত, প্রতিটি দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া। কূটনৈতিকভাবে চাপে না ফেললে এ সংকট আরও বাড়বে।পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মনে করেন, এ সংকটের দায় অনেকটাই বাংলাদেশের নিজের। তার ভাষ্য, ভিসা নিয়ে বিভিন্ন দেশ যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে, সে জন্য মূলত দায়ী বাংলাদেশি নাগরিকদের অনিয়মিত অভিবাসনপ্রবণতা এবং ব্যবসায়ীদের অব্যবস্থাপনা। তারা নিয়ম না মেনে লোক পাঠান, ফলে বিভিন্ন দেশের সরকারের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।