দশম গ্রেড চেয়ে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে টানা তিন দিনের অবস্থান কর্মসূচি ও সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে বেতন পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ আশ্বাস পেয়ে শিক্ষকরা সাময়িকভাবে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন।সোমবার রাতে সচিবালয়ে অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর শিক্ষক নেতাদের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা আসে।প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক খায়রুন নাহার লিপি সমকালকে বলেন, আমাদের মূল দাবি ছিল দশম গ্রেড। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের জন্য ১১তম গ্রেড বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিয়েছে। আমরা সেই আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করছি। তবে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন শিক্ষক নেতারা। সাধারণ শিক্ষকরা এ সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি, তারা চেয়েছিলেন দশম গ্রেডের প্রজ্ঞাপন। চারটি সংগঠনের নেতারা এবার এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা গত রাতে সাধারণ শিক্ষকদের তোপের মুখে পড়ে শহীদ মিনার ছেড়ে চলে যান। রাতে সাড়ে ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় শহীদ মিনারে অবস্থানরত শিক্ষকরা ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। তারা নিজ নিজ সংগঠনের নেতাদের খুঁজছিলেন।
তিন দিন ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি ও দুদিন ধরে সারাদেশে কর্মবিরতি চলছিল। সোমবারও শহীদ মিনারে শিক্ষকরা স্লোগান, গান ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরছিলেন।সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলের পশ্চিম শ্রীফলকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বুড়ি দাতিনাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বুড়ি গোয়ালিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। সেসব স্কুলে ক্লাস চলেছে।আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে আছে সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দশম করা, প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড দশম বাস্তবায়ন দ্রুত সম্পন্ন করা, পুলিশের বাধা ও হামলার ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বৈঠকে কী হলো
সচিবালয়ে বিকেল সাড়ে ৫টায় শুরু হয়ে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানাসহ অর্থ বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।শিক্ষক নেতাদের পক্ষে অংশ নেন আবুল কাশেম, শামছুদ্দিন মাসুদ, খায়রুন নাহার লিপি, মাহবুবুর রহমান, আনিচুর রহমান, শাহীনূর আল আমিন, শাহিনুর আক্তারসহ ১৭ জন।সভা শেষে অর্থ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান বেতন স্কেল উন্নীত করার বিষয়ে অর্থ সচিব বলেন, বেতন ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি অর্থ বিভাগ জাতীয় পে কমিশন ২০২৫-এ পাঠিয়েছে। এটি পে কমিশনের বিবেচনাধীন রয়েছে। পে কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে। শিক্ষকদের ১০ এবং ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির বিষয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে অর্থ সচিব জানান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অর্থ বিভাগে একটি প্রস্তাব করলে অর্থ বিভাগ বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান বিধিমালার আলোকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
১১তম গ্রেডে কী সুবিধা বাড়বে শিক্ষকদের
সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম করলে বেতন দিতে বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এই গ্রেডে মূল বেতন শুরুতে হয় ১১ হাজার টাকা। ১১তম গ্রেড কার্যকর হলে তাদের মূল বেতন শুরুতে হবে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও সরকারি আনুতোষিক ভাতাগুলো যুক্ত হবে।বর্তমানে কর্মরত বেশির ভাগ সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন বেড়ে ১১তম গ্রেডের কাছাকাছি। আর্থিক সুবিধা অল্প বাড়লেও তাদের সম্মান বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বর্তমান বেতন গ্রেড ১১তম। সম্প্রতি দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে রিট আবেদনকারী ৪৫ জন প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়িয়ে দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে সারাদেশের সব প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেড দশম হওয়ার পথ তৈরি হয়। সে ব্যাপারে প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
দশম গ্রেড পেতে বড় বাধা এসএসসি-এইচএসসি পাস শিক্ষক
দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনও ৬৬ হাজার ২৯৭ শিক্ষক রয়েছেন, যারা এসএসসি, এইচএসসি, দাখিল বা আলিম পাস। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই দশম গ্রেড পেতে বড় বাধা। এই শিক্ষকরা পুরোনো নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত। অনেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেননি। ফলে আধুনিক পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে বহু ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়।শিক্ষা অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এসএসসি-এইচএসসি পাস শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার আগে দশম গ্রেড বাস্তবায়ন করলে বেতন কাঠামোতে বৈষম্য তৈরি হবে, যা বর্তমান উচ্চ শিক্ষিত সহকারী শিক্ষকদের জন্যও বিব্রতকর হতে পারে। এই শিক্ষকদের অবসরে যেতে আরও অন্তত ৮-১০ বছর লাগবে।