
আগামী ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো জাতি। ভূ-রাজনৈতিক কারণে অনেক দেশের চোখ এখন বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। তাই আগামী নির্বাচনে শুধু ভোটারদের আস্থা ফেরানোই নয়, আরও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আগামী নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। সরকারের তরফ থেকে ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে ভোট হতে পারে- এমন একটি বার্তা ইসির কাছে রয়েছে। নির্বাচন প্রশ্নহীন করতে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম- ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো, অন্তর্র্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, বিশ^াসযোগ্য পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুমোদন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, কেন্দ্র প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটার উপস্থিতি।বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জের। তবে এই নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ ভোটারদের আস্থা ফেরানো। গত তিনটি নির্বাচন যেভাবে একতরফা হয়েছে তাতে মানুষ ভোট দেওয়ার সংস্কৃতি ভুলে গিয়েছিল। তাই আগামী নির্বাচনে ভোটররা যাতে নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আরও একটি বড় কাজ হচ্ছে নির্ভুল ভোটার তালিকা। অতীতে মৃত ব্যক্তিরও ভোটার তালিকায় থাকা নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া একজনের ভোট অন্যজনের দিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও ছিল। তা ছাড়া আগের রাতে ভোটের বাক্স ভর্তির অভিযোগও ছিল বিগত নির্বাচনে। এসব কলঙ্ক কাটিয়ে আগামী
নির্বাচন হবে ঘুরে দাঁড়ানোর নির্বাচন। মানুষের মাঝে আবার ভোটের সংস্কৃতি ফিরে আসবে। দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা সুসংহত হবে। এটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।ভোট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব থাকে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর। গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বিগত সরকারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ যেভাবে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, তাতে এখনও সাধারণ মানুষ পুলিশকে আস্থায় নিতে পারেনি। তা ছাড়া পুলিশ তাদের হারানো মনোবল ফিরে পায়নি। তাই নির্বাচনের আগে পুলিশের মনোবল ফেরানো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আগামী নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এতে প্রার্থীদের বিরোধী নানা অপপ্রচারের একটা সুযোগ দেখছেন অনেকে। তাই সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা ইসির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে।আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং মাঠ প্রশাসনের সহায়তায় কালো টাকার প্রভাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তিও অর্থের প্রভাবে সংসদ সদস্য হয়েছেন। যার ফলে জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটেনি। এবারের নির্বাচনে সেই প্রভাব কতটা কাটিয়ে ওঠা যাবে তা নিয়েও রয়েছে না বিশ্লেষণ।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হলেও তাদের সমর্থকদের ভোট পড়বে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন আশা করেন, আওয়ামী লীগ না থাকলেও তাদের সমর্থকরা ভোট দিতে আসবেন।আওয়ামী লীগ না থাকলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কিনা- এ প্রশ্নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্বাভাবিক। আমাদের চিন্তা হলো- যারা ভোটার আছেন, তারা অংশগ্রহণ করেন কিনা। আমরা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে চাই। এখন ইনক্লুসিভের ডেফিনিশন তো একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে মনে হয়, ভোটাররা অংশগ্রহণ করলেই অন্তর্র্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে।বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের কোনো একটি দল ভোটে না থাকলে সেই নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা, সে নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্র প্রশ্ন তুলবে কিনা- জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করেছে সরকার। সেটা এখন আদালতের ওপর নির্ভর করছে। তাই আওয়ামী লীগকে ভোটে রাখা না রাখা সম্পূর্ণ আদালতের ওপর নির্ভর করছে। আর যে দলটির বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ, সেই দল ভোটে না থাকলে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা মেনে নেবে না- বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা মনে হচ্ছে না। বরং জাতিসংঘসহ অন্যান্য রাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। তাই আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ না থাকলেও ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জের। এই কমিশনের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নির্ভুল ভোটার তালিকা, দলের নিবন্ধন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ ইত্যাদি।বিশ্লেষকরা মনে করেন, অতীতের নির্বাচনে ছিল সন্ত্রাস, কালো টাকার ব্যবহার, কেন্দ্র দখল, প্রভাবশালীদের কব্জায় থাকত আসনগুলো। তাই সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাতে দেশের গণতন্ত্র চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য আগামী নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিতর্কহীন করতে এসব বিষয়ে নজর বাড়াতে হবে। নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা হলেই গণতন্ত্র সুসংহত হবে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে।