
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ কাটাতে নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ)। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সভায় গৃহীত এ সিদ্ধান্তকে অনেকেই যুগান্তকারী বলছেন। তবে বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, আইনগত জটিলতা ও রাজনৈতিক চাপ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগকে ঘিরে নানা বিতর্ক চলেছে। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের হস্তক্ষেপ, ঘুষ-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল সর্বজনবিদিত। যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুণ নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য ও আর্থিক লেনদেন অনেক সময় নিয়োগ নির্ধারণ করেছে। ফলে ভুগতে হয়েছে দেশের অসংখ্য স্কুল-কলেজ, যেখানে দুর্বল নেতৃত্বের কারণে একাডেমিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে।আগে ম্যানেজিং কমিটির তত্ত্বাবধানে নিয়োগ দেওয়া হতো। কমিটির প্রস্তাবিত কয়েকজন প্রার্থীর নাম শিক্ষা বোর্ডে পাঠাত, বোর্ড সেখান থেকে একজনকে বাছাই করত। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছিল অনিয়মে ভরা।
গত ২৮ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে একটি প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান ও সহকারী প্রধান, সুপারিনটেনডেন্ট, সহকারী সুপার এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ থেকে প্রার্থী নির্বাচন ও সুপারিশ সংক্রান্ত প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ আইন সংশোধন ও একটি নতুন ধারা, উপধারা সংযোজন, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সহকারী প্রধান এবং কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ বিধিমালা প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে।এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ ভয়াবহ ছিল। প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ হওয়ার যোগ্য অনেকে বাদ পড়েছেন শুধু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। এতে যারা নিয়োগ পেতেন, তারা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে রাজনৈতিক মহলের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন। এই দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা দিয়েছে প্রশাসনিক স্থবিরতা, একাডেমিক মানহানি, শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ-অনিয়ম এবং শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা।
কতটা চ্যালেঞ্জ? প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগ ক্ষমতা হস্তান্তর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা, প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর।এনটিআরসিএ এখন থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সরাসরি তত্ত্বাবধান করবে। যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি হবে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে, সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠানপ্রধান নির্বাচন করা হবে।এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, এটি আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রধান নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নেতৃত্বের মান বাড়বে। এই ব্যবস্থায় মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত হবে, দুর্নীতির সুযোগ কমবে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষতা বাড়বে এবং শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।শিক্ষাবিদরা বলছেন, ডিজিটাল নিয়োগ ব্যবস্থা চালু করা, অনলাইন আবেদন ও উন্মুক্ত মেধাতালিকা প্রকাশ, বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন এবং এনটিআরসিএর জনবল ও বাজেট বাড়ানো ছাড়া এ উদ্যোগ টেকসই হবে না। সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আমরা চাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ্য নেতৃত্ব আসুক। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে এনটিআরসিএকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্য নেতৃত্ব। এ জন্য প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ নিয়োগে কোনো অনিয়ম বরদাশত করা হবে না।অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। রাজধানীর একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সামছুন নাহার বলেন, স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যায়। মেধাভিত্তিক নিয়োগই সমাধান। তবে কেউ কেউ সতর্ক করেছেন, এনটিআরসিএ যেন নতুন করে আরেকটি নিয়োগ ব্যবসার আখড়া না হয়ে ওঠে।