
শরিয়াভিত্তিক দুর্বল পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূতকরণের (মার্জার) প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংকগুলো একীভূত করে সরকারি বড় একটি ইসলামী ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নতুন এই ব্যাংকের নাম অনুমোদন করা হতে পারে। এরপর আরজেসিতে নিবন্ধনের পর ওই নামে লাইসেন্স ইস্যু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নতুন নামে ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হতে আরও অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ কেবল সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকেই রক্ষা করবে না, বরং পুরো খাতের স্থিতিশীলতা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হবে।বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ ব্যাংক মিলে নতুন নামে বড় একটি ইসলামি ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করবে। আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ব্যাংকটির নাম অনুমোদনের প্রস্তাব উঠবে। এরপর আরজেসিতে নিবন্ধিত হয়ে ওই নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করবে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স ইস্যুর পরই একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ৫ ব্যাংকে প্রশাসক বসানো হবে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই বছরের মতো সময় লাগবে।ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রাজধানীর মতিঝিলে সেনাকল্যাণ ভবনে একটি প্রকল্প কার্যালয় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নতুন ব্যাংকের প্রস্তাবিত নাম ঠিক করা হয়েছে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক ।
জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভায় ব্যাংকগুলো একীভূত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে যে ব্যয় হবে, সেই তহবিল পেতে বিলম্ব হওয়ায় কার্যক্রম এগোচ্ছে ধীরগতিতে। তবে নভেম্বরের মধ্যে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ৫ ব্যাংক একীভূত করার জন্য যে তহবিল দরকার, সেটি এখনও পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রশাসক বসানোয় দেরি হচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে ৫ ব্যাংকের একীভূতের প্রস্তাব উঠবে। সেখানে তহবিলের বিষয়টিও আলোচনা হবে।জানা যায়, দুর্বল ৫ ব্যাংক একীভূত করতে ব্যয় হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ব্যাংকের আমানত বীমা তহবিল থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারে রূপান্তরিত করা হবে। বাকি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে। সরকারের পক্ষে পরিচালনগত দিক দেখাশোনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যেভাবে সম্পন্ন হবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক ৫টির দায়, সম্পদ ও জনবল এক করা হবে। পরে তা অধিগ্রহণ করবে ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক। নতুন এই ব্যাংকের মূলধনের বড় অংশ জোগান দেবে সরকার। তাই এটির পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের রাখা হবে। নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা। নতুন ব্যাংকের প্রকল্প কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষ কর্মকর্তাদেরও পদায়ন করা হবে। তার আগে ৫ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশাসক হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক পদের কর্মকর্তা, যাদের নাম ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রশাসক ব্যাংকগুলোর এমডির দায়িত্ব ও দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। প্রশাসক নিয়োগের পর বাতিল করা হবে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ।
আইনি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে : শরিয়াহভিত্তিক ৫ ব্যাংকের একীভূতকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৮ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠিত হয়। একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আইনগত বাধা আছে কি না খতিয়ে দেখছে কমিটি।
৫ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি : পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। ৫ ব্যাংকের মধ্যে শতাংশের হিসাবে সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংকে। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ শতাংশ ও এক্সিম ব্যাংকে ৪৮ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।